সৌরভ দত্ত:
কোপা আমেরিকা গেল সেই আর্জেন্টিনাতেই। ফাইনালে নীল-সাদা জার্সিধারীরা হারাল কলম্বিয়াকে। এক্সট্রা টাইমে লাওতেরো মার্টিনেজের অনবদ্য গোলে কোপা চ্যাম্পিয়ন হল নীল-সাদা জার্সিধারীরা। মার্টিনেজ যখন গোল করলেন, তখন খেলার বয়স ১১২ মিনিট। তার পরে ম্যাচে ফেরার মরিয়া চেষ্টা করেছিল কলম্বিয়া। কিন্তু দিনটা যে আর্জেন্টিনার।
লিও মেসি চোট পেয়ে উঠে গিয়েছিলেন ৬৫ মিনিটে। রেফারির শেষ বাঁশির পরে বাঁধনহারা উচ্ছ্বাসে ভাসতে দেখা গেল তাঁকেও। মেসি উঠে যাওয়ায় চাপে পড়ে গিয়েছিল আর্জেন্টিনা। কিন্তু দি মারিয়া, ডি পল, মার্টিনেজরা অধিনায়কের জন্য জীবনপণ করলেন মাঠে। নির্ধারিত নব্বই মিনিটে কোনও দলই গোল করতে পারেনি। অতিরিক্ত সময়ে আর্জেন্টিনার হয়ে গোলটি করেন মার্টিনেজ।
নির্ধারিত সময়ে শুরু হয়নি এদিনের কোপা ফাইনাল। আর্জেন্টিনা-কলম্বিয়া ফাইনাল প্রায় ৮০ মিনিট দেরিতে শুরু হয়। মায়ামির হার্ড রক স্টেডিয়ামে চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলা। টিকিট ছাড়াই মাঠে ঢোকার চেষ্টায় অসংখ্য দর্শক। নিরাপত্তাকর্মীরা কিছুতেই তাদের নিরস্ত করতে পারছিলেন না।
বৈধ টিকিট রয়েছে এমন অনেক দর্শক মাঠে ঢুকতে গিয়ে আহত হন। এমন অবস্থায় ফাইনাল শুরুর নির্ধারিত সময় দফায় দফায় পিছিয়ে দেওয়া হয়। শেষমেশ ভারতীয় সময় ৬.৪৫ মিনিট নাগাদ শুরু হয় খেলা।
খেলার শুরুতে কলম্বিয়া চাপ তৈরি করে আর্জেন্টিনার উপরে। ৬ মিনিটে কর্ডোবার শট নীল-সাদা জার্সিধারীদের পোস্টে লেগে প্রতিহত হয়। তার পরেও নিরন্তর চলে কলম্বিয়ার আক্রমণ। ২০ মিনিটে মেসির শট বাঁচান কলম্বিয়ার গোলকিপার ভারগাস। প্রথমার্ধে কলম্বিয়াকে অনেক সপ্রতিভ দেখিয়েছে। চলে কলম্বিয়ার আধিপত্য। ৩৫ মিনিটে কলম্বিয়ান ডিফেন্ডারের কড়া ট্যাকলে চোট পান মেসি। তিনি মাঠে ফিরলেও সেভাবে জ্বলে উঠতে পারেননি। দ্বিতীয়ার্ধে আর্জেন্টিনাকে উজ্জ্বল দেখায়। দি মারিয়ার শট বাঁচান কলম্বিয়ান গোলকিপার। বেশ কয়েকবার কলম্বিয়ার রক্ষণে আক্রমণ তুলে আনে তারা। কিন্তু ৬৫ মিনিটে হৃদয় ভাঙে আর্জেন্টিনীয়দের। চোট পেয়ে মাঠ ছাড়েন মেসি। কাঁদতে থাকেন তিনি।
মেসির জায়গায় মাঠে নামানো হয় নিকোলাস গঞ্জালেসকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই কর্ডোবার ট্যাকলে চোট পেয়ে মাঠের বাইরে চলে যান গঞ্জালো মনতিয়েল। তাঁর জায়গায় মাঠে নামেন নাহুয়েল মলিনা। এদিকে নিকো গঞ্জালেস কলম্বিয়ার জালে বল জড়ালেও তা অফসাইডের অজুহাতে বাতিল হয়ে যায়। ৮৭ মিনিটে বক্সের মধ্যে গোলকিপারকে একা পেয়ে গোল করতে পারেননি দি মারিয়া। আর অ্যাডেড টাইমে দি মারিয়ার সেন্টারে মাথা ছোঁয়াতে পারেননি নিকো গঞ্জালেস। নব্বই মিনিটে খেলা গোলশূন্য থাকায় কোপা ফাইনাল গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। এক্সট্রা টাইমের দ্বিতীয়ার্ধে গোলের দারুণ সুযোগ তৈরি করে ফেলেছিল কলম্বিয়া। কিন্তু সেখানে সতর্ক ছিলেন আর্জেন্টাইন ডিফেন্ডার। তার পরই সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। লাওতেরো মার্টিনেজের দুর্দান্ত গোলে আর্জেন্টিনা ফের কোপা চ্যাম্পিয়ন।
দলগত পারফরম্যান্সের দাম পেয়েছে আর্জেন্টিনা। ২০২৪ সালে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে লিওনেল মেসির দেশ।
যে খেলোয়াড়ের সেই পুরস্কার পাওয়ার কথা ছিল, তিনিই সেটা পেলেন। এবারের কোপা আমেরিকায় দুর্দান্ত খেলেছেন কলম্বিয়ার অধিনায়ক হামেস রদ্রিগেজ। ফাইনালেও খুব ভালো খেলেছেন। সবমিলিয়ে ছ’টি অ্যাসিস্ট করেছেন। একটি গোল করেছেন রিয়াল মাদ্রিদের প্রাক্তন তারকা।
২০২৪ সালের কোপা আমেরিকার সর্বোচ্চ গোল করার জন্য গোল্ডেন বুট জিতলেন লাউতারো মার্টিনেজ। মোট পাঁচটি গোল করেছেন তিনি। আর সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ গোলটা করেছেন ফাইনালে। ফ্লোরিডার হার্ডরক স্টেডিয়ামে ১১২ মিনিটে তিনি যে গোলটা করেন, সেটার উপর ভর করেই কোপা জিতল আর্জেন্টিনা।
টুর্নামেন্টে এমিলিয়ানো মার্টিনেজ থাকবেন, সেটার উদ্বোধনী ম্যাচের আগেই আর্জেন্টিনার তারকা সেরা গোলকিপারের পুরস্কার দিয়ে দেওয়া যেতে পারে। অবিশ্বাস্য ফর্মে আছেন তিনি। এবারের কোপা আমেরিকায় পাঁচটি ম্যাচে ক্লিনশিট রেখেছেন। শুধু তাই নয়, ফাইনালে গুরুত্বপূর্ণ সেভ করেছেন। নাহলে শুরুতেই গোল খেয়ে যেতে পারত আর্জেন্টিনা।
প্রথম চারটি সংস্করণে রানার্স-আপ হওয়ার পরে আর্জেন্টিনা প্রথমবার কোপা আমেরিকা জিতেছিল ১৯২১ সালে। তারপর থেকে ১৯২৫ সাল, ১৯২৭ সাল, ১৯২৯ সাল, ১৯৩৭ সাল, ১৯৪১ সাল, ১৯৪৫ সাল, ১৯৪৬ সাল, ১৯৪৭ সাল, ১৯৫৫ সাল, ১৯৫৭ সাল, ১৯৫৯ সাল, ১৯৯১ সাল, ১৯৯৩ সাল, ২০২১ সাল এবং ২০২৪ সালে কোপা জিতেছে। অর্থাৎ ১৬ বার জিতেছে কোপা। মোট ১৪ বার রানার্স-আপ হয়েছে
১৫ বার কোপা আমেরিকা জিতেছে লুইস সুয়ারেজের দেশ। ১৯১৬ সাল, ১৯১৭ সাল, ১৯২০ সাল, ১৯২৩ সাল, ১৯২৪ সাল, ১৯২৬ সাল, ১৯৩৫ সাল, ১৯৪২ সাল, ১৯৫৬ সাল, ১৯৬৭ সাল, ১৯৮৩ সাল, ১৯৮৭ সাল, ১৯৯৫ সাল এবং ২০১১ সালে কোপা আমেরিকার খেতাব জিতেছে উরুগুয়ে। ছ’বার রানার্স-আপ হয়েছে।
কোপা আমেরিকার খেতাব মোট ন’বার জিতেছে ব্রাজিল। ১২ বার রানার্স-আপ হয়েছে। ১৯১৯ সাল, ১৯২২ সাল, ১৯৪৯ সাল, ১৯৮৯ সাল, ১৯৯৭ সাল, ১৯৯৯ সাল, ২০০৪ সাল, ২০০৭ সাল এবং ২০১৯ সালে জিতেছিল। ২০২১ সালে ব্রাজিল ফাইনালে উঠেছিল। এবার তো সেমিফাইনালেও উঠতে পারেনি ব্রাজিল।
এখনও পর্যন্ত দু’বার কোপা আমেরিকার খেতাব জিতেছে প্যারাগুয়ে। প্রথমবার জিতেছিল ১৯৫৩ সালে। আর দ্বিতীয় কোপা আমেরিকার খেতাব ১৯৭৯ সালে জিতেছিল। ফাইনালে পৌঁছেছিল ছ’বার – ১৯২২ সাল, ১৯২৯ সাল, ১৯৪৭ সাল, ১৯৪৯ সাল, ১৯৬৩ সাল এবং ২০১১ সাল। একটা সময় বেশ দাপট থাকলেও এখন প্যারাগুয়ের আর সেই ফর্ম নেই।
১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে যে কোপা আমেরিকা চলছে, তাতে দু’বার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে চিলি। আর সেটা পরপর দু’বছরে। ২০১৫ সাল এবং ২০১৬ সালে জিতেছিল। দু’বার ফাইনালে হারিয়েছিল আর্জেন্টিনাকে। নিজেরা চারবার রানার্স-আপ হয়েছিল – ১৯৫৫ সাল, ১৯৫৬ সাল, ১৯৭৯ সাল এবং ১৯৮৭ সাল।
কোপা আমেরিকার ইতিহাসে দু’বার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে পেরু। ১৯৩৯ সাল এবং ১৯৭৫ সালে খেতাব জিতেছিল। আর একবার রানার্স-আপ হয়েছিল। সেটা ২০১৯ সালে। ব্রাজিলের কাছে হেরে গিয়েছিল ফাইনালে। সেই বছরই শেষবার কোপা জিতেছিল ব্রাজিল।
কলম্বিয়া এবং বলিভিয়া – দু’দলই একবার করে কোপা আমেরিকার খেতাব জিতেছে। কলম্বিয়া জিতেছিল ২০০১ সালে। রানার্স-আপ হয়েছিল ১৯৭৫ সালে। আর ২০২৪ সালেও রানার্স-আপ হল। অন্যদিকে, ১৯৬৩ সালে বলিভিয়া জিতেছিল। আর রানার্স-আপ হয়েছিল ১৯৯৭ সালে।