সৌরভ দত্ত :
স্প্যানিশদের ফুটবলের নয়া দৌড় শুরু হয়ে গিয়েছিল আজ থেকে ১৬ বছর আগে। বার্লিনে মাটিতে সেই বৃত্ত যেন আরও একবার পূর্ণ হল। ইংল্যান্ডকে হারিয়ে ইউরোপ সেরা হল স্পেন। আজ থেকে ১২ বছর আগে ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে ইতালিকে হারিয়ে শেষবার ইউরো কাপ জিতেছিল তারা। বার্লিনে স্প্যানিশ তিকিতাকায় পরাস্ত ইংল্যান্ড। অপরাজিত হয়ে।
প্রাক্তনরা বলছেন, গত ১৬ বছর পর এবারের ইউরোর মঞ্চে স্পেন একটা বিপ্লব। শুরু থেকে শেষ, লা রোজারা গোটা টুর্নামেন্টে প্রতিপক্ষকে বুঝতে দিলেন না, তাঁরা কী খেলবেন, এবং কী খেলছেন। মূলত লুইস দেলা ফন্তের মগাস্ত্রে শেষ হয়ে গেল প্রতিপক্ষরা। আসলে গত কয়েক বছরে চিরাচরিত তিকিতাকা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেছিল স্পেন। কিন্তু সিনিয়র দলের দায়িত্ব নিয়ে সেই ধারাকেই এবার ফিরিয়ে এনেছেন স্প্যানিশ কোচ।
তাই ইয়ামেল, পেড্রির মতো তরুণরা মিশে গিয়েছেন রডরিগো, ড্যানি ওমলোদের অভিজ্ঞতার সঙ্গে। সাফল্য এসেছে দলগত ভাবে। ইউরো জয় হয়ে গেল। সামনে ২০২৬ সালের বিশ্বকাপ। ২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে শেষবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন স্পেন। নতুন করে প্রহর গোনা শুরু হল বার্লিন থেকেই।
বার্লিনের অলিম্পিয়াস্টেডিয়ন স্প্যানিশ আর্মাডার দখলে। প্রথম দল হিসেবে চারবার ইউরো কাপ জিতে ইতিহাসের পাতায় স্পেন। পাঁচে চার। গত পাঁচ ইউরোর মধ্যে চারবার চ্যাম্পিয়ন স্পেন। টানা সাত ম্যাচ অপরাজিত থেকে আরও একবার ইউরো কাপ জিতল স্পেন। রবিবার রাতে বার্লিনে ইংল্যান্ডকে ২-১ গোলে হারালেন মোরাতারা। পরীক্ষায় পাস লুইস ডেলা ফুয়েন্তে। ইয়ুথ দল থেকে সিনিয়র দলের দায়িত্ব নিয়েই সাফল্য। ডেভিড ভিয়া, জাভি, ইনিয়েস্তার যুগের পর এল জামাল, উইলিয়ামসের যুগ। একজনের বয়স ১৬, অন্যজনের ২২। দুইয়ের যুগলবন্দিতে চ্যাম্পিয়ন স্পেন। ইউরো ফাইনালের সেরা নিকো উইলিয়ামস। অনবদ্য পারফরম্যান্স। সবচেয়ে বর্ষীয়ান অধিনায়ক হিসেবে ইউরো জয় আলভারো মোরাতার। ৩১ বছর ৮ মাসে এই নজির গড়লেন। এর আগে এই রেকর্ড ছিল ইগর ক্যাসিয়াসের। ৩১ বছর ১ মাসে জিতেছিলেন তিনি। এদিন তাঁকে ছাপিয়ে গেলেন মোরাতা। ইউরো কাপের ইতিহাসে সবচেয়ে সফল দল স্পেন। আরও দীর্ঘায়িত হল ইংল্যান্ডের ৫৮ বছরের অপেক্ষা। ১৯৬৬ সালের পর কোনও আন্তর্জাতিক ট্রফি নেই থ্রি লায়ন্সদের। এদিনও রানার্স তকমা নিয়েই থামতে হল। আগেরবার ইতালি, এবার স্পেন। তবে এদিন যোগ্য দল হিসেবেই চ্যাম্পিয়ন স্পেন। টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচ থেকেই ধারাবাহিক। তাঁদের গতিশীল পাসিং ফুটবল নজর কাড়ে। পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে ইউরোর সেরা দলের জয়।
স্পেন গোটা ইউরোতে যেভাবে খেলেছে, ফাইনালেও একইভাবে শুরু করে। বলের দখল থেকে শুরু করে আক্রমণ, সবই বেশি ছিল ফুয়েন্তের দলের। কিন্তু অ্যাটাকিং থার্ডে গিয়ে যাবতীয় আক্রমণ আটকে যায়। সেই ঝাঁঝ ছিল না। ফাইনাল মানেই স্নায়ুর লড়াই। যা দুই দলের খেলাতেই স্পষ্ট। কেউই অলআউট ঝাঁপায়নি। স্পেন গোলের চেষ্টা করলেও রক্ষণাত্মক ফুটবল খেলে ইংল্যান্ড। কাউন্টার অ্যাটাক ভিত্তিক ফুটবল খেলে গ্যারেথ সাউটগেটের দল। শুরুতে একটু নড়বড়ে দেখায় জামালকে। তার কৃতিত্ব প্রাপ্য লুক শয়ের। অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে প্রথমার্ধে জামালকে রুখে দেন। তবে পেনাল্টি থেকে বঞ্চিত হয়ে স্পেন। লাপোর্তেকে বক্সের মধ্যে ফাউল করা হয়। নিশ্চিত পেনাল্টি। কিন্তু ভার এর সাহায্য পর্যন্ত নেননি রেফারি।
বিরতির পরই নিকো উইলিয়ামসের গোলে এগিয়ে যায় স্পেন। ম্যাচের ৪৭ মিনিটে ডানদিক থেকে লামিনে জামালের গোলের ঠিকানা লেখা পাস। চলন্ত বলে বাঁ পায়ের শটে নিখুঁত প্লেসিং।
তার দু’মিনিটের মধ্যে ব্যবধান বাড়াতে পারত স্পেন। কিন্তু উইলিয়ামসের পাস থেকে বাইরে মারেন দানি ওলমো। নিশ্চিত সুযোগ মিস। গোলটা হয়ে গেলে তখনই ম্যাচের ভাগ্য নির্ধারণ হয়ে যেতে পারত। ইউরোর এক পর্বে সবচেয়ে বেশি অ্যাসিস্টের নজির গড়লেন জামাল। মোট সংখ্যা চার। যা রেকর্ড। নিঃসন্দেহে ইউরোর আবিষ্কার ১৬ বছরের উইঙ্গার। আরও একটি অ্যাসিস্ট হতে পারত। কিন্তু ৫৫ মিনিটে মোরাতার শট লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। তার এক মিনিটের মধ্য উইলিয়ামসের শট বাইরে যায়। দ্বিতীয়ার্ধে ফোর্থ গিয়ারে শুরু করে স্পেন। ঝড়ের গতিতে আক্রমণে ওঠে। তাতেই আরও ছন্নছাড়া ফুটবল ইংল্যান্ডের। গোলের সুযোগ ছিল জামালের সামনেও। কিন্তু তাঁর শট ডানদিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঁচান পিকফোর্ড।
ম্যাচের ৬১ মিনিটে হ্যারি কেনকে তুলে ওয়াটকিন্সকে নামান ইংল্যান্ডের কোচ। সুযোগ নষ্টের খেসারত দিতে হয় স্পেনকে। ম্যাচের ৭৩ মিনিটে সমতা ফেরান কোল পালমার। সেমিফাইনালে সুপার সাব হিসেবে নেমে গোলে অ্যাসিস্ট করেছিলেন। এদিন গোল করলেন। সাকার থেকে বেলিংহ্যামের পা ছুঁয়ে বক্সের বাইরে থেকে বাঁ পায়ের শটে বক্সের বাইরে থেকে দারুণ গোল পালমারের। এরপরও সুযোগ এসেছিল স্পেনের সামনে। ম্যাচের ৮২ মিনিটে সামনে একা ইংল্যান্ডের গোলকিপারকে পেয়েও তাঁর হাতে তুলে দেন জামাল। তবে সেই মহেন্দ্রক্ষণের জন্য বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি। ম্যাচের ৮৬ মিনিটে জয়সূচক গোল ওয়ারজাবাল। বাঁ দিক থেকে কুকুরেল্লার মাইনাসে ডান পায়ের আলতো পুশে গোল স্প্যানিশ সুপার সাবের। চলতি ইউরোয় একাধিকবার পিছিয়ে থেকেও ম্যাচে ফেরে ইংল্যান্ড। এদিনও সংযুক্তি সময় ফের সমতা ফেরানোর সুযোগ পায় ইংল্যান্ড। রাইসের হেড বাঁচান স্পেনের কিপার। ফিরতি বলে ওয়াটকিন্সের হেড গোললাইন থেকে ফেরত পাঠান দানি ওলমো।
ভাগ হয়ে গেল সোনার বুট। ইংল্যান্ডের হ্যারি কেনকে দ্বিতীয়ার্ধে তুলে নেন হেড কোচ গ্যারেথ সাউথগেট। হ্যারি কেন ৭ ম্যাচে তিনটি গোল করেছেন। স্পেনের দানি ওলমো পাঁচ ম্যাচে তিনটি গোল করেছেন।
তাঁদের সঙ্গেই সোনার বুট ভাগ হলো নেদারল্যান্ডসের কডি গাকপো (৬ ম্যাচে ৩ গোল), জর্জিয়ার জর্জেস মিকাউতাডজে (৪ ম্যাচে ৩ গোল), জার্মানির জামাল মুসিয়ালা (৫ ম্যাচে ৩ গোল) ও স্লোভাকিয়ার ইভান স্ক্র্যাঞ্জের (৪ ম্যাচে ৩ গোল) মধ্যে।
উইলিয়ামস এদিন ম্যাচের সেরার পুরস্কার পেয়েছেন। ফাইনালে তাঁর গোলটির পিছনে ছিল লামিনে ইয়ামালের অবদান। ইয়ামালের বাড়ানো পাস ধরেই তিনি স্পেনের প্রথম গোলটি করেন। চারটি অ্যাসিস্ট ও একটি গোল করায় ইয়ামাল পেলেন ইয়ং প্লেয়ার অব দ্য টুর্নামেন্ট পুরস্কার।
ইউরো কাপে সর্বকনিষ্ঠ হিসেবে গোল করেছিলেন। এদিন মেজর টুর্নামেন্টের ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ হিসেবে ফাইনাল খেলে ভাঙলেন পেলের রেকর্ড। ম্যানচেস্টার সিটিতে খেলা স্প্যানিশ তারকা রদ্রি পেলেন টুর্নামেন্টের সেরার পুরস্কার। যদিও চোট পাওয়ায় বিরতির পর তিনি নামতে পারেননি।